পত্রিমিতালী

একটা বয়সে এসে একজন বিশেষ বন্ধুর বড় প্রয়োজন হয়ে পড়ে, এমন কত কামনা বাসনা আছে, মানসিক যন্ত্রণা বা অভাববোধ, ইচ্ছে - অনিচ্ছে যা বাড়ির কারো কাছে ব্যক্ত করা যায়না কিম্বা বন্ধু বান্ধবীদের কাছে বল্লেও হয়তো হাসির পাত্রী হতে হয়। তাই জীবনে সব থেকেও সেই বিশেষ বন্ধুটির অভাব বড় প্রকট হয়ে পড়ে, জীবনের পাকদণ্ডি বাইতে বাইতে।

আমাদের প্রীতিলতার জীবনটাও সেই অর্থে বেশ বিড়ম্বনাময় ফ্যাকাসে ছিল, সম্ভ্রান্ত অতীব রুচিশীল, রক্ষণশীল পরিবারের একমাত্র বিবাহযোগ্যা মেয়ে প্রীতিলতা রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী হলেও ভাগ্যের অমোঘ পরিহাসে পরিণয় সূত্র হতে বঞ্চিত ছিল। এদিকে বয়সও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছিল তার।  প্রীতিলতার, পিতা-মাতা আত্মীয়-পরিজন চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি একটা সময়ে অবধি। কিন্তু বিধি বাম, সঠিক পাত্র অমিল সর্বত্র। প্রীতিলতার মনের সব দুঃখ, হতাশা, ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলো অপ্রকাশিত থাকতে থাকতে মৃত ফসিলে রূপান্তরিত হতে বসেছিল প্রায়। কিন্তু, মানুষের মন ভারী বিচিত্র! এমতাবস্থায়, ভারী অদ্ভুত একটা পথ অবলম্বন করল প্রীতিলতা। সে তার মনের যাবতীয় ইচ্ছা-অনিচ্ছা গোপন আশা আকাংখাগুলো তার ঘরে ঘুলঘুলিতে থাকা একটি টিকটিকির কাছে ব্যক্ত করা শুরু করলো রাতে-দিনে সবার অলক্ষ্যে। সব থেকে বিষ্ময়ের ব্যাপার হলো, তার প্রত্যেক কথায় কথায় টিকটিকিটাও কি জানি কোন অনুরাগে নানা প্রকারের আওয়াজ করত। প্রীতিলতা ভালোবেসে তার নাম রেখেছিল উচ্চৈঃশ্রবা। এরকম যখন অবস্থা, এক বান্ধবীর পরামর্শে প্রীতিলতা, খবরের কাগজে প্রকাশিত পত্র-মিতালীর বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। সে শুনেছিল, পত্র-মিতালীতে মনের মত বন্ধু খুঁজে পাওয়া যায়। সেই থেকে চিঠি লেখায় বড় মন তার, শুধু লেখে আর লেখে। সারাক্ষন তার মন পড়ে থাকে মনের মত কোন উত্তরের আশায়, এমনকি তার অসময়ের পরম বন্ধু উচ্চৈঃশ্রবাকেও ভুলতে বসল সে।

এমনি, হঠাৎ একদিন রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন এলো, সে উচ্চৈঃশ্রবার পিঠে চেপে চলেছে কোন এক অলীক জগতে মেঘের দেশে। একটা বিশাল ফটকের সামনে নামিয়ে দিয়ে উচ্চৈঃশ্রবা দৌড়ে পালিয়ে গেল সেই ফটকের মধ্যে দিয়ে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রীতিলতা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো ফটকের বাইরে; কিন্তু উচ্চৈঃশ্রবা আর ফিরলো না! তখন বাধ্য হয়েই সে ফটকের ভেতর উঁকি দিল আর পরম আশ্চর্যের সাথে দেখলো পাহাড়; চিঠির পাহাড়! যতদূর চোখ যায় অগুনিত চিঠি, নানান আকারে বাহারে রঙিন সব চিঠি। হঠাৎ একটা চিঠির পাহাড়ের ওপর নজর পড়লো তার, সে দেখলো উচ্চৈঃশ্রবা একটা গোলাপী রঙের চিঠি মুখে নিয়ে বসে আছে সেই পাহাড়ের ওপর। প্রীতিলতা দৌড়ে গেল সেই চিঠি নিতে! কিন্তু, কিছুটা গিয়েই তার পা বসে গেল একটা চিঠির পাহাড়ে আর সে ধীরে ধীরে ডুবে যেতে থাকলো চিঠির চোরা বালিতে। প্রচণ্ড আতঙ্কে প্রীতিলতা বাঁচার চেষ্টা করতে লাগলো আর ঠিক সেই সময়ই ভোরের অ্যালার্মটা কর্কশ শব্দে বাজতে শুরু করলো আর তার ঘুম ভেঙে গেল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রীতিলতা ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে বসল। আর সেই মুহুর্তেই তার নজর আটকে গেল বিছানার পাশে রাখা টেবিলের ওপর রাখা ঘড়িটার দিকে, একটা গোলাপী চিঠির খাম আর তার ওপর নিষ্পন্দ পড়ে আছে প্রীতিলতার অসময়ের বন্ধু অতি আদরের উচ্চৈঃশ্রবা!

প্রীতিলতার মন ব্যাকুল হয়ে উঠল; হঠাৎ বন্ধু বিয়োগে, ভারাক্রান্ত মনে পরম স্নেহের সাথে সে টিকটিকিটার মৃত শরীর নিজের হাতে তুলে নিল আর তার তপ্ত অশ্রুকণা দিয়ে মৃত উচ্চৈঃশ্রবাকে জানাল বন্ধুত্ত্বপূর্ণ শেষ বিদায়। অন্য হাতে গোলাপী খামে বন্দি চিঠিটা তুলে পড়তে আরম্ভ করল সে, আর সাথে সাথেই তার বিষাদঘন অশ্রুকণা নির্মল আনন্দাশ্রুতে পরিবর্তিত হল। চিঠির শেষ ভাগের লেখাগুলো তার একলা মনের বিশেষ বন্ধু না পাবার শূণ্যতাকে হঠাৎ পূর্ণ করে দিল এক লহমায়। “অনেক গল্প আছে বাকি! এক সাথে হাতে হাত ধরে চলবে আমার সাথে? শুধু বলো তুমি রাজি...।                                                                              ইতি...

(সমাপ্ত)

Write a comment ...

তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়

Show your support

Struggling writers always need support from their readers, as its too hard for the newbies managing a chance to stand on a platform where established branded authors exists.

Write a comment ...

তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়

Creative Writer and a freelance photographer