স্লিপার সেল (ছোট গল্প)

মাস আষ্টেক হলো কলকাতায় এসেছে গার্গী। প্রথমে সে পুরোনো কলকাতায় স্থিত শ্বশুর বাড়িতেই উঠেছিলো!  কিন্তু, সেই বিয়ের পর যে ঝামেলাটা সহ্য করতে না পেরে তার বাইরে পোস্টিং নিয়ে চলে যাওয়া, ঠিক সেই একই ঝামেলার পুনরাবৃত্তি শুরু হয়েছিলো মাস দুয়েক শ্বশুর বাড়ি থেকে অফিস যাতায়াত করার সময়।
সর্ব প্রথম শুরু করলেন, কাকা শ্বশুর তারপর যথাক্রমে নিজের শাশুড়ি ও বাড়ির অন্যান্য বয়স্ক সদস্যরা;
কী না বাড়ির বউ, চাকরী করছে তা করুক, এখন সবাই করে! তাতে আপত্তি নেই, যদিও বাসু বংশের মেয়েদের নাকি মাটিতে পা ফেলা বারণ সেই আদি যুগ হতেই! কিন্তু, সে তো এই বংশের পুত্রবধু! তো সে এসব না মানতেই পারে কিন্তু তাই বলে; হুটপাট বাড়ী থেকে বেরিয়ে যাওয়া বা রাত বিরেতে বাড়ির বাইরে কাটানো, অসময়ে অফিস থেকে ফেরা, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই এক ঝামেলা একান্নবর্তী পরিবারে!

তাই, একান্ত বাধ্য হয়েই এই হরদয়াল ঘোষ লেনের বারোশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটটা কিনে আলাদা হয়ে আসা। অবশ্য, ঋদ্ধিমান তাকে আগেই বলেছিল, ফ্ল্যাট অ্যারেঞ্জ করেই যেন সে ট্রান্সফারটা নেয়, কিন্তু গার্গীই ভেবেছিলো, শ্বশুর বাড়ীর প্রাগৈতিহাসিক মতাদর্শ হয়তো বা এতদিনে বর্তমান যুগের হাত ধরে উন্মুক্ততার ছোঁয়া লেগেছে। কিন্তু সে যে চূড়ান্ত ভুল ছিল, তা তো নিজেই ভালো করে টের পেয়েছে এই কয় মাসে।

হরদয়াল ঘোষ লেনের এই পাড়াটি বেশ ভদ্র আর উচ্চবিত্ত মানুষের পাড়া, সবাই নিজের নিজের মত থাকতে পছন্দ করে, খুব একটা গায়ে পড়ে আলাপ করতে আসার লোক এখনো চোখে পড়েনি। অবশ্য গার্গীর পেশা অনুপাতে, খুব কম উচ্চবিত্তই চাইবে তার সাথে আলাপ করতে, কেই বা চায় আইনকে আদর করে নিজের খোলস উন্মুক্ত রূপ দেখাতে। ক্রাইম ব্রাঞ্চের সুদক্ষিণা বাসু ওরফে গার্গীর নাম এরই মধ্যে প্রিন্টিং মিডিয়ার ফ্রন্ট পেজ নেম হিসেবে পরিচিতী লাভ করেছে, কারণটা অবশ্য খান তিনেক হাই প্রোফাইল পেন্ডিং কেস! সেগুলি সে সলভ করেছে অবলীলায় এবং খুব কম সময়ের ব্যবধানে, তার প্রখর বুদ্ধিবলে। এখন সে পশ্চিমবঙ্গের, রাজ্য পুলিশ মহলে বহুল চর্চিত একজন দুঁদে মহিলা পুলিশ অফিসার। শুধু কি তাই, গুণের সাথে সাথে রূপেও সে ডাকসাইটে সুন্দরী। সেইজন্যেও পুলিসের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে তার বিউটি উইথ ব্রেন, বেশ একটা চর্চার বিষয়। গার্গী'র অবশ্য এসব খারাপ লাগে না! সব মেয়ের মতোই সেও চায় তার কর্মক্ষেত্রে সেই আলোচনার সেন্ট্রাল ক্যারেক্টার হিসেবে থাকতে! ক্ষতি কী, পুরুষ শাসিত এই সমাজের বুকে যদি একজন নারী হয়ে এইভাবে ছড়ি ঘুরিয়ে পুরুষের দম্ভকে চ্যালেঞ্জ করতে পারা যায় তো, তার চেয়ে আর বেশি কী পাবার থাকতে পারে…! অবশ্য ঘরে ঋদ্ধিও তাকে বেশ অ্যাডমায়ার করেই চলে।

তিন মাস হলো ঋদ্ধিও, ব্যাঙ্গালোরের অতো বড় আইটি ফার্মের চাকরীতে ইস্তফা দিয়ে হঠাৎ চলে এলো কলকাতায়, কি না আর দূরে দূরে থাকার কোন মানে হয় না। এখন সে চায় কলকাতায় নতুন ব্যবসা চালু করতে, আর একসাথে ঘর বাঁধার স্বপ্নটাকে বাস্তবে রূপ দেবে। তা বেশ ভালোই হলো। কলকাতায় এসেই ঋদ্ধির নজর পড়েছে গার্গীর ফ্ল্যাটের উল্টোদিকের ডুপ্লেক্স বাংলোটার প্রতি, বেশ পচ্ছন্দ হয়েছে তার বাংলোটা! তার মতে ফ্ল্যাটের চেয়ে নিজস্ব একটা বাংলো থাকলে মন্দ কি? স্ট্যাটাস বাড়বে বই কমবে না। অবশ্য বাংলোটা বেশ সুন্দর। ইতি মধ্যে বাবু আবার খোঁজ ও নিয়ে ফেলেছেন বাঙ্গলোটির সম্পর্কে। বাংলোর মালিক এক বৃদ্ধ দম্পতি, ইউকে না ইউএসএ কোথায় একটা থাকে। বাংলোটা সেরকম দর পেলে বেচে দিতেও পারেন তাঁরা। সামনের বছর ডিসেম্বরে নাকি আসবেন কলকাতায় তখন নাকি ঋধি কথা বলবে তাঁদের সাথে খরিদারির ব্যাপারে। এখন কিছু অল্প বয়সি ছেলে থাকে বাংলোটার এক তলায় রেন্টে, সামনের হাজরা অঞ্চলের হোটেল ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউটের ছাত্র।

এত সুন্দর ডিটেল্ড ইনফরমেশন শুনে গার্গী মজাচ্ছলে বলেছিল, তাহলে এসব আইটির খটমটে কাজ ছেড়ে তুমি বরং একটা ডিটেক্টিভ এজেন্সি খুলে ফেল, আমারো কাজের সুরাহা হবে তাতে। তারপর কফির মগের ধোঁয়া উড়িয়ে এক ছুটির দিনের সান্ধ্য আড্ডায় ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে বসে স্বপ্নের বাংলোটার দিকে চেয়ে দুজনেই হাসির ফোয়ারা ছুটিয়েছিলো।

একটা স্বপ্ন দেখতে দেখতে গার্গীর ঘুমটা আজ সকাল সকাল ভেঙে গেলো, সে উঠে পড়ে পাশ ফিরে দেখলো ঋদ্ধি অকাতরে ঘুমোচ্ছে, কাল বেশ রাত্তির অব্দি ল্যাপটপে কিসব কাজ নিয়ে ব্যাস্ত ছিলো কে জানে! খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিলো, নতুন সেটাপের অফিসে এখন খুব কাজের চাপ চলছে, বলছিল কদিন আগেই। কি একটা নতুন প্রজেক্টের সমাপন না করা অব্দি নাকি ওর রাতের ঘুম উড়ে গেছে। এখনো সে ভাবে আলো ফোটেনি বাইরে, তবু গার্গী বিছানা ছেড়ে উঠে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। আহ, প্রথম ভোরের মৃদুমন্দ শীতল বাতাসের আমেজ তার মন প্রাণ স্নিগ্ধ করে দিলো। একটা মিষ্টি মাতাল করা গন্ধ বাতাসে মিশে আছে, বড়ো পরিচিত গন্ধ। পূবের আকাশে ধীরে ধীরে ভোরের হাল্কা নীল রঙ ধরছে, গাছে গাছে নিদ্রা ভেঙে, পাখিরা কলরব মূখর হয়ে নতূন দিনকে স্বাগত জানাচ্ছে। গার্গী নিজের দুচোখ বন্ধ করে, নিজের দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে দিলো নতুন ভোরকে আলিঙ্গনের আশায়। সে যে স্বপ্ন দেখেছে সে-ঋদ্ধি আর তাদের ছোট্ট শিশু সন্তানের ওই সামনের বাংলোর বাগানে নিরবিচ্ছিন্ন আনন্দের এক মুহূর্তের। আজ এই ব্যাপারে ঋদ্ধির সাথে কথা বলবে ভেবেছে সে। আর দেরী করা ঠীক হবে না, নারীর মনে আজ মাতৃত্বের ছোঁয়া লেগেছে। এমনি সময়ে তার মনে হলো কেউ বা কারা যেন তাকে দেখছে আড়াল থেকে। কিন্তু কে! বারান্দার আশপাশটা আর রাস্তার দিকেও নজর চালাল গার্গী। নাহ, এত সকালে কেউ তো নেই! কে জানে হয়তো মনের ভুল! এই ভেবে বারান্দা সংলগ্ন তার মাস্টার বেডরুমের স্লাইডিং ডোরটা সরিয়ে, ঘরে ঢুকে পড়লো সে। রাতের নাইট বালব আর এসিটা বন্ধ করে, বিছানার পাশের জানলাটা খুলে দিতেই ভোরের হাল্কা আলোয় ঘর ভরে গেলো আর সেই আলোর ছোঁয়ায়, হাল ফ্যাশন ড্রেসিং টেবিলে রাখা কাঁচের গোল পটের মধ্যে স্থির হয়ে থাকা, তিন্নি-তান্নাও কেমন অস্থির হয়ে উঠলো, ব্ল্যাক গোল্ড ফিস দুটো তিরতির করে লেজ নাড়িয়ে জানান দিতে থাকলো “সুপ্রভাত”। মিষ্টি হেসে ড্রাই ফুডের কৌটোটা হাতে তুলতে গিয়ে আয়না দিয়ে, তার চোখ আটকালো ঋদ্ধিমানের মুখের ওপর, উফঃ! কি ভীষণ, হ্যান্ডসাম তার বরটা! গভীর ঘুমের মধ্যে ঋদ্ধির মুখে ফুটে ওঠা অদ্ভুত সারল্যমাখা শিশু সুলভ হাসিটা, তার বড্ডো প্রিয়! বিয়ের পর, এমন কত রাতে, ঘুমন্ত বরকে হাঁ করে চেয়ে দেখেছে গার্গী। কি ছিলো সেই সব দিনগুলো, তারপর চাকরী সূত্রে দুজনে দুদিকে।

ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং! ঘড়িতে পাঁচটা বাজলো! নাহ, এবার দেরি হয়ে যাচ্ছে! দিন শুরু হচ্ছে এবার, এখন অনেক কাজ, ফ্রেস হয়ে, ঋদ্ধিকে ঘুম থেকে তুলতে হবে, তার পর জগিং, জিম সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আটটা, তারপর রেডি হয়ে ঠিক দশটায় ইউনিটের সাথে যোগ দিতে হবে ভবানিভবনে। একটা জরুরি মিটিং আছে। চট-জলদি তিন্নি-তান্নাকে খাবার দিয়ে, দ্রুত বাথরুমে ঢুকে পড়লো গার্গী। সব কিছু রেডি করে ট্র্যাক সুটটা গলাচ্ছে যখন, ঋদ্ধি এসে পেছন থেকে উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো, “ম্যাডাম তোমার এই খোকাটি, বালিশের তলায় সেই থেকে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে হাল্লাক হচ্ছিল। নাও, আমার সতীন ফোন করেছে।” গার্গী আঁতকে উঠে তাড়াতাড়ি ফোনটা নিয়ে হ্যালো বলতেই ওপার থেকে ভেসে এলো জলদগম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠের আওয়াজ, রাঘব জয়েশওয়াল! জয়েন্ট কমিশনার অব পোলিস; “হ্যাল্লো! ইয়াং লেডী, ইটস এমার্জেন্সি, গেট রেডী সুন, আই এম অন মাই ওয়ে, উইল পিক ইউ আপ ফ্রম হোম।” যাহ্! এমনিতেই, বিজি স্কেডিউলের জন্য আজকাল, শরীরের যত্ন নেওয়া হয় না,ধুর আজকের মত জগিং, জিম গোল্লায় গেলো। কি হলো কে জানে, যবে থেকে সে এই কলকাতায় বদলী হয়ে এসেছে, তবে থেকে আজ এই কেস নয় কাল ওই কেস, একটা না একটা লেগেই আছে। বিরক্তিকর! এত সুন্দর একটা শহরে কোথা থেকে যে এত ক্রিমিনালের আমদানি হলো, কে জানে বাবা! চট জলদি স্নান সেরে রেডি হতে হতেই, নিচ থেকে- পিঁ পিঁপ পিঁ! রাঘব স্যারের গাড়ির হর্ণ শোনা গেলো আর গার্গীর চিন্তাসূত্রে বাধা পড়লো। ঋদ্ধিকে বাই বলে বেরোতে যাবে, এমনি সময় বাবু বলে উঠলো, “আমার সতীনটিকে বলো, যখন তখন অন্যের বউকে এভাবে ডাকাতি করে তুলে নিয়ে যাবার কোন রাইট ওনার নেই। বিয়েথা করেননি বুঝবেন কি করে বউয়ের মূল্য! নিজের কাজকেই যে স্ত্রী রূপে ভালোবেসেছেন… হুমহ! বলে দিও একদিন ওই স্ত্রীয়ের ওপর আমিও হস্তক্ষেপ করবো, মেরা ভি ওয়াক্ত আয়েগা!” গার্গী-ঋদ্ধির কথায় হেসে মুখ বেঁকিয়ে, একটা ফ্লাইং কিস হাওয়ায় ভাসিয়ে বেরিয়ে গেল। নিচে রাঘব স্যার, গাড়িতে হেলান দিয়ে কপাল কুঁচকে কিছু চিন্তা করছিলেন, ওকে দেখে বলে উঠলেন, “সকালের নিউজ কিছু দেখেছো?” গার্গী লজ্জাবনত মুখে বলে উঠলো “না স্যার!” শুনে তিনি বললেন, “এই এক সমস্যা তোমাদের জেনারেশনের, তোমরা নিউজের চেয়ে নেটের বাসি খবরে বড় নির্ভরশীল!” সকাল বেলার কালো পিচ ঢালা রাস্তা চিড়ে প্রচণ্ড গতিতে গাড়ী পুলিশ হেড-কোয়ার্টারের দিকে ধাবিত হলো। পেছনের কর্ডন ভ্যানটাও সকাল বেলার নিস্তব্ধতাকে চুরমার করে চিরাচরিত উচ্চগ্রামের সাইরেন বাজিয়ে সরকারি নিল সাদা পুলিশি বাতি জ্বালিয়ে ওদের সঙ্গ দিল।

একটা সিরিয়াল বম্বিংইয়ের খবর এসেছে স্পেশাল লিঙ্কের মাধ্যমে, হাতে দিন সাতেক সময়, তাই রেড এলার্ট জারি হচ্ছে। সারা কলকাতা জুড়ে, হাইরাইজ, মল আর ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান গুলো পুলিশের ঘেরাটোপের মধ্যে ইতি মধ্যেই চলে গেছে, সব সরকারী দপ্তর থেকে, হাসপাতাল – রেলওয়ে স্টেশন, বিমান বন্দরে কড়া পুলিশি পাহারা, এবারে আর মাছি গলতে দেওয়াও যাবে না, ইজ্জত কা সওয়াল হ্যায়, সাথে সাধারণ মানুষের জীবনের সুরক্ষাও যে জড়িত। কেসটাতে সুদক্ষিণা বাসু ওরফে গার্গীকেই রেকমেণ্ড করা হয়েছে স্টেট মিনিস্ট্রি বোর্ড থেকে তাই আজ সকাল সকাল মিটিং করে ওকে চার্জ বুঝিয়ে দেওয়া হল, আর ওর গাইড কাম পার্টনার থাকবেন রাঘব স্যার। সারাদিনটা, নানান মিটিং আর প্ল্যানিংয়ে কেটে গেলো। ঋদ্ধিকে, একটা ফোন করতে হবে এখন কদিন ওভার টাইম ছাড়া উপায় নেই। এমন সময় কন্ট্রোল রুম থেকে খবর এলো ২০৬এর বি হরদয়াল ঘোষ লেনে প্রচণ্ড গুলির লড়াই চলছে। মাথাটা ধাঁ করে ঘুরে গেলো গার্গীর বলে কি, এই ঠিকানা তো তার উল্টো দিকের ডুপ্লেক্স বাংলোটার! ঋদ্ধিকে সঙ্গে সঙ্গে ফোনে ধরার চেষ্টা করলো সে, কিন্তু, সবসময় সুইচ অন থাকা ঋদ্ধির ফোন আজ সুইচড অফ। পুলিশের আর্মড ফোর্স আর ক্রাইম ব্রাঞ্চের স্পেশাল ফোর্সের দশ’টা ভ্যান রাত্রের অন্ধকারে যখন পৌঁছালো স্পটে তখন গুলির লড়াইয়ের তীব্রতা বেড়েছে, নজরে এলো আশপাশের বাড়ি আর ফ্ল্যাটগুলো ইতি মধ্যেই জন শূন্য করে ফেলা হয়েছে, মানুষজনদের বার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নিরাপদ দূরত্বে, আর বাংলোটাকে ঘীরে রেখেছে ভারতীয় স্পেশাল কমব্যাট ফোর্সের জওয়ানরা। এলাকাটা পুরো একটা ছোটখাটো যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এই কয়েক ঘণ্টায়। ঘটনা চক্রে ঘটে যাওয়া এই অঘটনের হাত ধরে আরো একটা চমক বাকি ছিলো।

গার্গী চারিদিকে নজর চালাতে গিয়ে দেখতে পেল, তাদের ফ্ল্যাটের গায়ে গ্রেনেডের টাটকা আঘাত আর ভেঙে ঝুলে পড়া বারান্দার কিছুটা অংশ, দেখে গাটা রিরি করে উঠলো তার, এরি মধ্যে রাঘব স্যার জওয়ানদের মধ্যে এক অফিশিয়ালের সাথে কি সব কথা বলে তাকে ডেকে বল্লেন, এটা জাস্ট বাড়াবাড়ি, সেন্ট্রাল ফোর্সের কোন অধিকার নেই আমাদের কাজে বাধা দেবার বা আমাদের স্টেট অথরিটিকে না জানিয়ে এভাবে হুটপাট কোনও একশান নেবার, এসব হচ্ছেটা কি। সঙ্গের অফিসিয়ালটি ওদেরকে কর্ডন করে নিয়ে গেল কিছুটা দূরের অনাস্থায়ী ক্যাম্পের সামনে, কমান্ডার বাসু নামক একজন চিফের কাছে, এই মিশনটা যিনি লিড করছেন। ওরা, ভেতরে ঢুকে দেখলো কমাণ্ডার বাসু পরবর্তী একশনের কিছু ডিটেলিং করছেন কিছু কমাণ্ডোকে! গার্গীদের সঙ্গী অফিসিয়ালটির সম্বোধনে ওদের দিকে কমাণ্ডার বাসু ঘুরে দাঁড়াতেই প্রায় ভুত দেখার মত চমকে উঠলো গার্গীরা, একি! এতো “ঋদ্ধি” কমান্ডার ঋদ্ধিমান বাসু গার্গীদের দেখে, বলে উঠলো আরেঃ! মিঃ রাঘব ওয়েলকাম, আসুন ম্যাডাম সুদক্ষিণা বাসু ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? তারপর গার্গীর দিকে চোখ টিপে কৌতুকের হাসি ছুঁড়ে দিয়ে, অতি সংক্ষেপে ঋদ্ধি শুরু করলো; সে একজন ভারত সরকারের নিয়োজিত আণ্ডার কভার এজেণ্ট, সিরিয়াল বম্বিং-এর খবর ওদের কাছে আগে থেকেই ছিলো। কিন্তু, এতো তাড়াতাড়ি একশান ডিক্লেয়ার হবে তা বুঝতে পারেনি, ওদের টিমটা কোলকাতার বুকে লুকিয়ে থাকা কিছু জঙ্গি সংগঠনের স্লিপার সেলের মাথাকে ট্র্যাক করছিলো এই কয়েক মাস যাবত, ঘটনাচক্রে কিছুদিন আগেই ইনফরমার মারফত সে জানতে পারে এই বাংলোটাই ওদের সেফ হাউস, মালিক দম্পতির কাছ থেকে বহু মূল্য অর্থে এই বাংলোটা কোন একটি গোষ্ঠী কিনে নিয়েছে জন স্বার্থের দোহাই দিয়ে। খবর অনুপাতে ট্র্যাকিং করে ঋদ্ধিরা জানতে পারে, হোটেল ম্যানেজমেন্টের ছাত্র বেশে যারা এখানে রেন্টে আছে তারা আসলে সেই জঙ্গি গোষ্ঠিরই অনুরাগী, আর সিরিয়াল বম্বিঙ্গয়ের যাবতীয় কার্জকলাপ এরা এখান থেকেই নির্বাহ করার ধান্দায় অস্ত্র ও আততায়ী জড়ো করছে! তাই “অপারেশন বিজয়কে” কনফার্ম করতে উঠেপড়ে লাগে সে। জঙ্গিরা গার্গীর পাড়াকেই সেফ জোন হিসেবে বেছে নিয়েছিল, এই ধারণায়, যে কেউই আশা করবে না, ক্রাইম ব্রাঞ্চের একজন হাই অফিসিয়ালের বাড়ির দোর গোড়ায় জঙ্গিরা লুকিয়ে থাকতে পারে। যাইহোক, এটা জাতীয় সুরক্ষা দপ্তরের ব্যাপার, স্টেট পুলিশের অধিকার খর্বের প্রশ্নই নেই। আর কথা শেষ করে ঋদ্ধি তার স্বভাব কৌতুক ছলে পূর্ণ হাসি হেসে গার্গীকে সম্বোধন করে বলে উঠলো কি সকালের কথাটা মেলাতে পারলাম তো ম্যাডাম সুদক্ষিণা বাসু? এতক্ষনে গার্গীর কাছে সব কিছুই জলের মত স্বচ্ছ, কিসের জন্য এতদিন ঋদ্ধি এতটা চিন্তান্বিত ছিলো, কেনই বা রাত জেগে কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ত থাকত, আর কেনই বা হঠাৎ তার কলকাতায় আগমন। রাগের বদলে, মনে মনে গার্গী, ঋদ্ধির তারিফ না করে পারলো না, ঋদ্ধির প্রতি তার ভালোবাসা ভালোলাগা আজ দ্বিগুণ থেকে চতুর্গুন বেড়ে গেল। সত্যি ঋদ্ধির ট্যালেণ্ট আছে মানতে হবে, তেমনি তার সুচারু অভিনয় ক্ষমতা, এতদিনে এক চুলও বুঝতে দেয়নি সে আসলে কোনও আইটি প্রফেশনাল নয়, একজন ডেয়ার ডেভিল স্পেশাল কমব্যাট ফোর্সের আধিকারিক। আজ দুঁদে ক্রাইম ব্রাঞ্চের অফিসার ইঞ্চার্জ সুদক্ষিণা বাসু হেরে গেল নিজের স্বামীর অভিনয় দক্ষতার কাছে। কিন্তু, তাতে সে এতটুকুও দুঃখিত বা বিচলিত নয় বরং এই হেরে যাওয়ায় এক প্রকার আনন্দ আর গর্ব মিশে আছে তার মন আজ খুশিতে ডগমগিয়ে উঠলো এই ভেবে যে ঋদ্ধি তার জন্য একদম পারফেক্ট একজন জীবন সঙ্গী।।

(সমাপ্ত)


Write a comment ...

তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়

Show your support

Struggling writers always need support from their readers, as its too hard for the newbies managing a chance to stand on a platform where established branded authors exists.

Write a comment ...

তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়

Creative Writer and a freelance photographer